দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে সিনেমা তারকাদের প্রভাব দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। তামিলনাড়ুতে বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগতের তারকারা রাজনীতিতে প্রবেশ করে বড় ভূমিকা রেখেছেন। সেই ধারায় এবার আলোচনায় এসেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা থালাপতি বিজয়।
বিজয়ের রাজনৈতিক অভিষেক
যোশেফ বিজয়, যিনি ভক্তদের কাছে "থালাপতি" নামে পরিচিত, গত বছর গঠন করেছেন নিজের দল তামিলাগা ভেট্টরি কাজাগাম (টিভিকে)। বাংলায় এর অর্থ "তামিল বিজয়ী মোর্চা"। দলের বয়স মাত্র এক বছর হলেও দুটি বড় সমাবেশে বিপুল তরুণ সমাগম ঘটেছে। সর্বশেষ সমাবেশে তিনি ঘোষণা দেন, আগামী বছর মাদুরাই থেকে বিধানসভা নির্বাচনে লড়বেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
তামিল রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি দল প্রভাব বিস্তার করেছে—দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) এবং অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (এআইএডিএমকে)। গত ৫০ বছর ধরে এই দ্বিদলীয় কাঠামো ভোটের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি কোনো আসন পায়নি, সবকটি ৩৯টি আসন কংগ্রেস, ডিএমকে ও বামরা জয় করে। বিজয়ের আবির্ভাব এই কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে পারে কি না, তা নিয়ে তামিলনাড়ু ও জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিনি।
বিজয় ও আদর্শের প্রশ্ন
বিজয় প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি নারী অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, অর্থনৈতিক সমতা ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজনীতির পক্ষে। তিনি দক্ষিণ ভারতের সমাজ সংস্কারক রামস্বামী পেরিয়ারের আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি দক্ষিণে রাজনৈতিক জমি তৈরি করতে বিজয়কে ব্যবহার করছে। যদিও বিজয় দাবি করেন, বিজেপি তাঁর "আদর্শিক শত্রু", আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ক্ষমতাসীন ডিএমকে।
মাদুরাই কেন্দ্রিক লড়াই
মাদুরাই, যাকে তামিলনাড়ুর সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়, সেখান থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন বিজয়। এখানে তাঁর বিশাল ভক্তগোষ্ঠী রয়েছে। বর্তমানে মাদুরাইয়ের লোকসভা আসন সিপিএমের ভেঙ্কটেশন দখলে রেখেছেন। এলাকায় বিজেপি-সংঘ পরিবার মুরুগান মন্দিরকে ঘিরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজয়ের প্রার্থী হওয়া এ প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা আনতে পারে।
অর্থনৈতিক শক্তি
বিজয় দক্ষিণ ভারতের ধনী তারকাদের একজন। ২০২১ সালে তাঁর সম্পদ ছিল প্রায় ৪০০ কোটি রুপি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিনি সর্বোচ্চ করদাতা অভিনেতা হিসেবে ৮০ কোটি রুপি কর দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোর ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁর আর্থিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই বিপুল সম্পদ নির্বাচনী লড়াইয়ে তাঁকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে।
রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
তামিল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড় অংশ ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেস ও বামদের সমর্থন করলেও বিজয়ের খ্রিষ্টান পরিচয় ভোটের সমীকরণে পরিবর্তন আনতে পারে। একইভাবে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা স্থানীয় মুসলিম ভোটারদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিনি যদি স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে না পারেন, তবে ভবিষ্যতে কংগ্রেস অথবা বিজেপির সঙ্গে জোট গড়তে হতে পারে।
অভিনেতা থেকে রাজনীতিবিদ: পুরনো ধারা
তামিলনাড়ুর ইতিহাসে অভিনেতা-রাজনীতিবিদদের সাফল্য-ব্যর্থতা দুই-ই আছে। এম. জি. রামচন্দ্র ও জয়ললিতা দীর্ঘ সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। অন্যদিকে কমল হাসান, রজনীকান্ত বা শিবাজি গণেশন সফল হতে পারেননি। বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী এম. কে. স্ট্যালিন নিজেও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির ছেলে, যিনি ছিলেন সিনেমার চিত্রনাট্যকার।
উপসংহার
থালাপতি বিজয়ের উত্থান তাই শুধু একজন তারকার রাজনীতিতে প্রবেশ নয়, বরং তামিলনাড়ুর দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ যোগ করার সম্ভাবনা। আগামী বছরের মাদুরাই নির্বাচনই ঠিক করবে, তিনি দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারবেন কি না।