ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে গেছেন, কিন্তু এই সফরের মাঝেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের চাপ মোকাবিলা করছেন।
গত বুধবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ওপর, যেমন হীরা ও চিংড়ি, শুল্ক ৫০ শতাংশে বেড়ে গেছে। ওয়াশিংটনের ভাষ্যে, দিল্লি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করার জন্য এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই শুল্ক ভারতের রপ্তানি খাত ও উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে চেষ্টা করছেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক তাদের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্বের দুই সর্বাধিক জনবহুল দেশ—ভারত ও চীন—সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুঁজতে পারে, যদিও সীমান্ত বিরোধের কারণে এই সম্পর্ক সবসময় অবিশ্বাসপূর্ণ ছিল।
চ্যাথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিগ বাজপেই ও ইউ জি মনে করেন, এই সম্পর্কের প্রভাব পুরো বিশ্বে পড়বে। তারা বলেন, ভারত কখনো চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেয়ালের ভূমিকা পালন করেনি, যা পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভাবত। তাই মোদির এই চীন সফর কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন মোড় ঘুরতে পারে।
ভারত ও চীন উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর দেশ। তারা যথাক্রমে বিশ্বের পঞ্চম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আইএমএফের মতে, ভারতের প্রবৃদ্ধি আগামী কয়েক বছরে ৬ শতাংশের ওপরে থাকবে। দেশটির অর্থনীতি ইতিমধ্যে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, শেয়ারবাজারের বাজারমূল্য ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উঠে আসবে।
বেইজিংভিত্তিক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান উসাওয়া অ্যাডভাইজরির প্রধান কিয়ান লিউ বলছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় এত দিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। এখন চীন ও ভারত কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে সম্পর্ক সহজ নয়। দুই দেশের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ এখনও মীমাংসিত হয়নি। ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে সরাসরি ফ্লাইট বাতিল, ভিসা ও চীনা বিনিয়োগ বন্ধ, এবং ২০০-এর বেশি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়।
আন্তর্জাতিক কৌশলবিষয়ক গবেষক অঁতোয়ান লেভেস্ক মনে করেন, সংলাপ জরুরি, কারণ ভারত-চীন সম্পর্ক গোটা এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া তিব্বত, দালাই লামা, যৌথ নদীর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও পাকিস্তানে হামলার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও সম্পর্ককে জটিল করে।
বর্তমানে ভারত-দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো নয়। বিপরীতে চীন পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। এশিয়া ডিকোডেডের প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলছেন, ভারতে কোনো বড় চীনা গাড়ি কারখানা হবে না, তবে কিছু ছোটখাটো সফলতা আসতে পারে।
এদিকে ভারত-চীন সরাসরি বিমান চালু হবে এবং ভিসা নীতি শিথিল হতে পারে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। তবে দিল্লি–বেইজিং সম্পর্ক এখনও অস্বস্তিকর। একসময় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জোট বেঁধেছিল, কিন্তু এখন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝতে পারছে না।
মোদি এবার সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) বৈঠকে যাচ্ছেন। এতে চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও রাশিয়া সদস্য। তবে ভারত এতদিন এসসিওকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। চলতি বছরের জুনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বৈঠকেও যৌথ বিবৃতি হয়নি, যেখানে ভারত আপত্তি তুলেছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ভারতকে আবার এসসিওর গুরুত্ব বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। চীনও ট্রাম্পের শুল্কের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের সংহতির ছবি দেখাতে চাইবে।
এছাড়া ব্রিকস জোটের দেশগুলো—যার মধ্যে চীন ও ভারতও আছে—ও ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্যবস্তু। তিনি হুমকি দিয়েছেন, নির্ধারিত হারের বাইরে অতিরিক্ত শুল্ক চাপানো হতে পারে।
সাম্প্রতিকভাবে মোদি চীনের আগে জাপান সফর করেছেন। এটি আঞ্চলিক মিত্রতার অংশ, যা সরবরাহশৃঙ্খলে সুবিধা এবং ‘মেক ইন এশিয়া ফর এশিয়া’ ধারণা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
চীন-ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের জন্য ভারত এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের কঠোর শিল্পনীতি চীনা আমদানি ও সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ইলেকট্রনিকস উৎপাদন, ভিসা সহজীকরণ এবং বিনিয়োগ সুযোগগুলো দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বড় সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
তবে সম্পর্ক জটিল। একটি বৈঠকেই সব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। মোদির এই সফরে অন্তত কিছু তিক্ততা কমতে পারে এবং ওয়াশিংটনকে বার্তা যাবে যে, ভারতের হাতে বিকল্প আছে।