বাংলাদেশ একটি অপার সৌন্দর্যের দেশ। ছোট এই ভূখণ্ডে আছে পাহাড়, সমুদ্র, ঝরনা, হাওর এবং শতবর্ষ পুরোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন। সাধারণত ভ্রমণ মানে আমরা শুধু সাজেক, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন বা হাওরগুলোর কথাই ভাবি। কিন্তু দেশের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে কম পরিচিত জায়গাগুলোতে।
লেখক নুসরাত রুষা জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের ৪৮টি জেলা ঘুরেছেন। একজন নারী হিসেবে ভ্রমণ করা কতটা চ্যালেঞ্জিং তা তিনি ব্যক্ত করেছেন। নিরাপত্তাহীনতা, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণ–হত্যার ভয় ভ্রমণকে কঠিন করে তোলে। তবুও নিজের দেশকে জানার জন্য তিনি পথে নামেন, মানুষের সঙ্গে মিশেন এবং প্রকৃতি ও ইতিহাস সরাসরি দেখেন।
পর্যটকদের জন্য কিছু জায়গা সহজলভ্য, যেমন সাজেক, বিছানাকান্দি, নীলগিরি, রাতারগুল, কুয়াকাটা, টাঙ্গুয়ার হাওর, কাপ্তাই বা নীলাদ্রী লেক। এখানে ট্যুরিস্ট গ্রুপ যায়, থাকার ব্যবস্থা আছে এবং নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত। তবে দেশের আসল বিস্ময় লুকিয়ে আছে মনপুরা, নিঝুম দ্বীপ, চর কুকরি-মুকরি, সন্দ্বীপ, নওগাঁর সাপাহার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার কমলাকান্দা, বান্দরবানের পাহাড়ি ট্রেইল এবং নাফাখুম, আমিয়াখুম, ভোলাখুমের ঝরনায়। অনেক জায়গায় স্থানীয়রাও যেতে ভয় পান।
ভ্রমণ না করার একটি বড় কারণ হলো খরচ। পরিবহন ও থাকার খরচ বাড়ছে, যা সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য অনেকটাই অসম্ভব। অনেক জায়গায় ভালো থাকার ব্যবস্থা নেই, আর যেখানে আছে, সেগুলোর ভাড়া শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে। ফলে প্রকৃতি ও ইতিহাসকে জানার আগ্রহ থাকলেও সীমিত সুযোগ-সুবিধা এবং উচ্চ খরচ অনেককে ভ্রমণ থেকে বিরত রাখে।
বাংলাদেশে ভ্রমণচর্চা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়, ঝরনা, নদী, সমুদ্র ছাড়া আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে কম নজর দিচ্ছি। ষাট গম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, সোমপুর মহাবিহার, নাটোরের ভবানীর রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবনের মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলো কম মানুষ ঘুরে দেখেন। অথচ ইতিহাসকে নতুন চোখে দেখা এবং সংস্কৃতিকে কাছ থেকে বোঝার সুযোগ এগুলোই দেয়।
নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় সমস্যা। নারী এবং সাধারণ পর্যটকদের জন্য অনেক ভ্রমণপথ এখনও নিরাপদ নয়। লেখক জানিয়েছেন, আগে একা দূরে ভ্রমণে বের হতে পারতেন, এখন নিজ এলাকা থেকেও ইভ টিজিংয়ের শিকার হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের নারী পর্যটকদের জন্য স্বপ্ন দেখা কঠিন হয়ে গেছে।
লেখক মনে করেন সাহিত্য ভ্রমণকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, লেখক ও কলামিস্টরা পর্যটন সচেতনতা তৈরি করতে পারেন। সাজেক বা সেন্ট মার্টিনের বাইরে মহাস্থানগড় বা মনপুরায় ভ্রমণ উৎসাহিত করা প্রয়োজন। গণমাধ্যম, সাহিত্য ও সিনেমা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে পর্যটনশিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, ভাষার বহুত্ব এবং খাদ্যসংস্কৃতি দেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে অসীম করে। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হলে দরকার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ, সরকারি ও সামাজিক অগ্রাধিকার এবং খরচ নিয়ন্ত্রণ। সমুদ্রের নীল, পাহাড়ের সবুজ, নদীর ঢেউ ও শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য—এসবের সৌন্দর্য ঠিকভাবে উপভোগ করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা এবং সমাজের মানসিক পরিবর্তন জরুরি।
বাংলাদেশে ভ্রমণ মানে শুধু ছবি তোলা নয়; এটি ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা, সংস্কৃতিকে বোঝা এবং প্রকৃতিকে উপভোগ করা। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবেশ নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন গন্তব্য হতে পারে।
লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়