খুলনা, ২৫ আগস্ট: খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ট্রাকের ধাক্কায় একটি ইজিবাইকের তিন যাত্রী নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও তিনজন। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার ভাণ্ডারপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ চালায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
সোমবার সকালে যাত্রীবাহী একটি ইজিবাইক স্থানীয় বাজার থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিল। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী ট্রাক সরাসরি ইজিবাইকটিকে ধাক্কা দেয়। প্রচণ্ড আঘাতে ইজিবাইকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই দুজন যাত্রীর মৃত্যু হয়।
ডুমুরিয়া ফায়ার সার্ভিস জানায়, খবর পেয়ে সকাল ৮টা ৪২ মিনিটে তাদের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান চালায়। আহত তিনজনকে স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ডুমুরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাসুদ রানা জানান, দুর্ঘটনাটি সকাল ৯টার দিকে ঘটে। ঘটনাস্থলেই দুজন মারা যান। গুরুতর আহতদের দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।
তিনি আরও বলেন, ট্রাকটি আটক করা সম্ভব হয়নি। চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছে। তাদের আটকের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন যাত্রী মারা যান। এতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় তিনজন। বর্তমানে হাসপাতালে চারজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, আহতদের শরীরে ভাঙা হাড় ও মাথায় আঘাতজনিত জটিলতা রয়েছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ট্রাকটি অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে চলছিল। মোড় ঘোরার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরাসরি ইজিবাইকটিকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কার শব্দে আশেপাশের মানুষ ছুটে এসে আহতদের উদ্ধার করে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ওই সড়কে নিয়মিতভাবেই দ্রুতগামী যানবাহন চলাচল করে। পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহতরা সবাই স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছেন। আহতদেরও পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে, তবে পরিবারের সদস্যদের অবহিত না করায় নাম প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয়রা জানান, নিহতদের মধ্যে একজন দিনমজুর, যিনি প্রতিদিনের মতো কাজের উদ্দেশ্যে ইজিবাইকে উঠেছিলেন।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতদের পরিবার-পরিজন হাসপাতালে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই সড়কে দুর্ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ৬,৫০০টির বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ৭,০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আরও ৯,০০০-এর বেশি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই ট্রাক, বাস ও থ্রি-হুইলার সংঘর্ষের কারণে ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন অমান্য, অযোগ্য চালক, এবং যথাযথ সড়ক অবকাঠামোর অভাব।
ওসি মাসুদ রানা জানান, ট্রাক ও চালককে আটক করতে অভিযান চলছে। এছাড়া দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণে তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্রি-হুইলার ওভারলোড ও দ্রুতগামী ট্রাকের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে। তারা মনে করেন, এ ধরনের যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নিশ্চিত করা দরকার। এছাড়া ট্রাক চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কঠোর তদারকি অপরিহার্য।
দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা সড়কে স্পিড ব্রেকার স্থাপন, ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো এবং বেপরোয়া চালকদের শাস্তির দাবি জানান।
একজন স্থানীয় শিক্ষক বলেন, “প্রায় প্রতি মাসেই এখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের সন্তানদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”
খুলনার ডুমুরিয়ায় ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের তিন যাত্রীর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো সমাজের জন্য বেদনার খবর। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ, নিরাপদ অবকাঠামো এবং চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এই মৃত্যুপুরী রোধ করা সম্ভব নয়।